
অনলাইন ডেস্ক:
আশরাফুল হুদা নামের এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে চুরি গেছে দামি এক পেইন্টিং। আর চুরিটা করেছেন তাঁর তিন বন্ধুর একজন। তদন্তে নামল খুদে গোয়েন্দা লব্ধ সৈকত। লিখেছেন শেখ আবদুল হাকিম
কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশের অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে ভালো। মানুষের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এর কারণ কী? কক্সবাজারে জাদু আছে নাকি?
জাদু নয়, প্রতিভা। সেটিকে রহস্যময়ই বলতে হবে। এই রহস্য মাত্র তিনজন মানুষ জানে; কিন্তু তারা মুখ খুলবে না।
কক্সবাজারের পুলিশপ্রধানের নাম বিপুল অর্জন। লোকজন তাঁকে জিনিয়াস বলে জানে, তবে তিনি নিজে কী জানেন সেটি কেউ জানে না।
এ কথা সত্যি যে বিপুল অর্জন অত্যন্ত দক্ষ একজন পুলিশ চিফ এবং তাঁর অফিসাররা সবাই খুব সৎ আর সাহসী। তবে অপরাধের বিরুদ্ধে এই শহরে যে যুদ্ধ চলছে, তার পেছনে সত্যিকার জিনিয়াস হলো পুলিশপ্রধানের একমাত্র ছেলে ১০ বছর বয়সী লব্ধ সৈকত। শার্লক হোমসের খুদে বাঙালি সংস্করণ, থ্রি কোয়ার্টার পরা একহারা গড়নের এক কিশোর, যার মগজে রয়েছে ক্ষুরধার বুদ্ধি।
বিপুল অর্জন যখনই কোনো জটিল রহস্য মীমাংসা করতে পারেন না, জিপ চালিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরেন তিনি। ডাইনিং রুমে খেতে বসে গল্প করার ছলে ছেলেকে শোনান কী ঘটেছে। প্রায় প্রতিবারই দেখা যায়, খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই সমস্যার সমাধান বের করে ফেলেছে সৈকত।
সেদিন শনিবার, সন্ধ্যারাতে খেতে বসেছে ওরা সবাই। পুলিশ চিফ বিপুল অর্জন কাবাবের টুকরোগুলো কাঁটা চামচ দিয়ে খোঁচাচ্ছেন, খাচ্ছেন না। সৈকত এবং ওর আম্মা, দুজনের চোখেই ব্যাপারটা ধরা পড়ল এবং ওদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে জটিল কোনো সমস্যায় পড়েছেন তিনি।
মা ও ছেলে অপেক্ষায় থাকল।
অবশেষে হাতের চামচ প্লেটে রেখে চেয়ারের পেছনে হেলান দিলেন পুলিশ চিফ। ‘আহসান মল্লিকের আঁকা খুব দামি একটা পেইন্টিং। আশরাফুল হুদার বাড়ি থেকে শুক্রবার রাতে চুরি হয়েছে।’
‘কিভাবে কী ঘটেছে লব্ধকে বললেই তো পারো।’ বাড়ির কর্ত্রী বললেন। ‘ওর মাথা থেকে কিছু একটা বেরোতে পারে। তোমার অনেক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে ও।’
বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন পুলিশ চিফ। ‘ঠিক আছে, বলছি। কিন্তু আমার কাছে সূত্র বলতে কিছুই নেই।’
পেইন্টিং চুরির ঘটনাটা তিনি যতটুকু জানেন, শোনালেন ছেলেকে।
আশরাফুল হুদা সাগর থেকে তিন মাইল দূরে দামপাড়া নামে এলাকায় বাংলো প্যাটার্নের একটা বাড়িতে থাকেন। মুর্তজা মল্লিকের পেইন্টিংটা ওই বাড়ির বৈঠকখানার দেয়ালে প্রায় ১০ বছর হলো ঝোলানো ছিল। শুক্রবার সকালে তাঁর স্ত্রী মিনতি হুদা চট্টগ্রামে গেছেন, সারা দিন মায়ের বাড়িতে বেড়িয়ে কাল সকালে ফিরবেন।
স্ত্রী বাড়িতে না থাকলেও, হুদা সাহেব খুব বেশিক্ষণ নিঃসঙ্গ ছিলেন না। দুপুরের পর তিনি তাঁর তিনজন বন্ধুকে তাস খেলার কথা বলে ডেকে নেন বাড়িতে। বন্ধুরা হলেন-আজাদুর রহমান, কায়সুল হক, মনির হায়দার।
চার বন্ধু একটানা তিন ঘণ্টা তাস খেলেন। তারপর ছয়টার দিকে খেলা বন্ধ করেন হুদা সাহেব-তাঁকে সৈকতের কাছাকাছি ধুমধাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যেতে হবে, মিসেস মিনতি হুদা চার প্রস্থ পেপার টাওয়েল কিনে রাখতে বলে গেছেন। তিন মাইল দূরত্ব, গাড়িতে পাঁচ মিনিট লাগবে পৌঁছতে।
পেইন্টিং চুরি
‘ধুমধাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর?’ মাঝপথে বাধা দিলেন সৈকতের আম্মা। ‘আমিও ওখানে কেনাকাটা করেছি। এত ভিড় হয়, দাম মেটানো ভারি ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। শুধু দাম মেটানোর জন্য এত লম্বা লাইন আর কোথাও আমি দেখিনি। কিছুদিন হলো ওরা স্পিড চেকআউট কাউন্টার খুলেছে, তাড়াতাড়ি দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসা যায়। তবে ওই কাউন্টারে দাম মেটাতে হলে তোমার কেনা জিনিসের সংখ্যা ১০টার বেশি হতে পারবে না।’
‘আমার মনে পড়ছে, এটা নিয়ে অনেক অভিযোগ করেছ তুমি।’ পুলিশ চিফ বললেন। ‘এখন তো বোধ হয় ওখান থেকে কিছু কেনোই না।’
‘আরো কটা স্পিড চেকআউট কাউন্টার খোলা উচিত ওদের।’ বললেন মিসেস অর্জন।
মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালেন পুলিশ চিফ, তারপর আবার নিজের গল্পে ফিরে গেলেন।
তিন বন্ধু আশরাফুল হুদাকে অনুরোধ করলেন, তিনি যখন শপিং করতে যাচ্ছেনই, তাঁদের জন্যও কিছু জিনিস যেন কিনে আনেন।
আজাদুর রহমান বললেন, দুটি বড় সাইজের পাউরুটি লাগবে তাঁর। মনির হায়দারের দরকার টুথপেস্টের চারটি টিউব। কায়সুল হক চান এক বোতল ভিনেগার।
হাজার হোক এঁরা সবাই বন্ধু মানুষ, কাজেই তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করতে হবে হুদা সাহেবকে। যেহেতু তাঁরা সবাই একই পাড়ায় থাকেন, কাজেই কেনার পর জিনিসগুলো তাঁদের হাতে তুলে দেওয়াটা কোনো সমস্যা নয়।
‘হুদা সাহেব যখন ধুমধাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, ওঁদের তিনজনের মধ্যে কেউ একজন হয়তো চুপিচুপি তাঁর বাড়িতে ঢুকেছিলেন।’ বললেন সৈকতের আম্মা।
‘হতে পারে।’ বললেন পুলিশ চিফ। ‘বাড়িটা প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো খালি ছিল। পেছনের দরজার কাচ ভেঙে ভেতরে ঢোকে চোর। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে ফিরে এসে হুদা সাহেব দেখলেন, বৈঠকখানার দেয়ালে পেইন্টিংটা নেই।’
‘তাঁর বন্ধুদের অ্যালিবাই আছে? অপরাধ ঘটার সময় তাঁরা কে কোথায় ছিলেন জানিয়েছেন?’ মিসেস অর্জন প্রশ্ন করলেন।
‘হুদা সাহেব যখন শপিং করছেন, তাঁর তিন বন্ধু তখন যে যার বাড়িতে ছিলেন।’ উত্তর দিলেন বিপুল অর্জন। ‘আজাদুর রহমান বলছেন, তিনি তাঁর গ্যারেজে একা ছিলেন, গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল মেরামত করছিলেন। মনির হায়দার বলছেন, তিনি ছিলেন বাড়ির পেছনের বাগানে, ফুলগাছের যত্ন নিচ্ছিলেন। কায়সুল হক ছিলেন নিজের পড়ার ঘরে, ঘণ্টাখানেক বই পড়েছেন। তবে তাঁদের কারো সাক্ষী নেই।’
‘তাহলে নিশ্চয়ই তাঁদের একজনই পেইন্টিংটা চুরি করেছেন।’ সৈকতের আম্মা বললেন। ‘একমাত্র তাঁরাই জানতেন যে হুদা সাহেব ধুমধাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে আছেন!’
‘না, ঠিক তা নয়।’ পুলিশ চিফ বললেন। ‘হুদা সাহেবকে অনেকেই গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে থাকতে পারেন। তাঁর পরিচিত লোকজনও তাঁকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দেখে থাকতে পারেন।’
‘হুঁ, তাই তো।’
চেয়ারে হেলান দিলেন চিফ। ‘তা ছাড়া।’ বললেন, ‘হুদা সাহেব আমাকে বলেছেন, তিনি যখন কেনাকাটা করতে স্টোরের ভেতর ঢুকছিলেন, তাঁর সঙ্গে পরিচিত দুই ব্যক্তির দেখা হয়। একজন নিলয় পোদ্দার, আরেকজন এরশাদুল হাদি। তাঁদেরও হুদা সাহেবের প্রতিবেশী বলা যায়, একই পাড়ার শেষ মাথায় থাকেন। কাজেই তাঁদেরও সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে।’
‘কিন্তু ভুলো না।’ বাড়ির কর্ত্রী বললেন, ‘শুধু কায়সুল হক, মনির হায়দার আর আজাদুর রহমান জানতেন যে হুদা সাহেবের স্ত্রীও বাড়িতে নেই, মায়ের কাছে বেড়াতে চট্টগ্রামে গেছেন। শুধু এই তিনজন জানতেন, হুদা সাহেব শপিং করার সময় বাড়িটা খালি থাকবে।’
‘তোমার এই কথাও ঠিক নয়।’ বললেন বিপুল অর্জন। ‘হুদা সাহেবের স্ত্রী প্রতি সপ্তায়, শুক্রবার সকাল ১০টার বাস ধরে চট্টগ্রামে যান, ফেরেন পরদিন সকালে। আমার ধারণা, অনেক মানুষই তাঁর এই রুটিন সম্পর্কে জানে।’
‘তাহলে প্রতিবেশীদের যে কেউ চোর হতে পারে।’ হতাশ সুরে বললেন মিসেস অর্জন।
‘শপিং মার্কেটে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কেউও হতে পারে।’
মিসেস অর্জন হাল ছেড়ে দিলেন। সাহায্য পাওয়ার আশায় সৈকতের দিকে তাকালেন তিনি। সূত্র বলতে গেলে কিছুই নেই, তাঁর ছেলে কি এই রহস্যের মীমাংসা করতে পারবে?
খুদে গোয়েন্দা চোখ বন্ধ করল। খুব গভীর চিন্তায় ডুবে গেলে এভাবে চোখ বন্ধ করে সৈকত।
তারপর হঠাৎ করেই চোখ মেলল। মাত্র একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল সে। সাধারণত খুব জটিল আর হতবুদ্ধিকর কেস সমাধান করতেও মাত্র একটা প্রশ্নের প্রয়োজন হয় তার।
‘হুদা আঙ্কেলকে এটা-সেটা কেনার অনুরোধ করা হয়েছিল, আমার প্রশ্ন হলো, এই অনুরোধ কার আগে কে করেন বা কার পর কে করেন?’
শার্টের বুক পকেট থেকে ছোট একটা নোটবুক বের করে পাতা ওল্টালেন চিফ। ‘এই যে, এখানে সব লেখা আছে। প্রথমে অনুরোধ করেন কায়সুল হক। তারপর আজাদুর রহমান। সব শেষে মনির হায়দার।’
সৈকতের প্রশ্ন শুনে মিসেস অর্জন কখনো হতাশ হন না। কিন্তু আজ খুবই হতাশ বোধ করছেন। তিনি বললেন, ‘কে আগে অনুরোধ করেছে, কে পরে করেছে-এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবছিস তুই? কেউ কিছু একটা এনে দেওয়ার অনুরোধ করলেই তাকে চোর ভাবা ঠিক নয়। আরে, আমি তো প্রায়ই আমার অনেক বন্ধুর জিনিসপত্র কিনে এনে দিই।’
‘কিন্তু কেউ আমাদের বাড়িতে চুরি করতে আসেনি, আম্মি।’ জবাব দিল সৈকত। ‘ওই পেইন্টিং চুরির রহস্য লুকিয়ে আছে হুদা আংকেল ধুমধাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কী করছিলেন তার ওপর।’
পুলিশ চিফ বিপুল অর্জন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, হঠাৎ করে তাঁকে সতর্ক দেখাচ্ছে, আগ্রহে চকচক করছে চোখ দুটো।
‘লব্ধ।’ বললেন তিনি, ‘আমি যদি সন্দেহ করার মতো কাউকে পাই…তার পেছনে একজন টিকটিকি লাগিয়ে রাখতাম, চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখত। তাহলে আগে হোক বা পরে, পথ দেখিয়ে আমাদের পেইন্টিংয়ের কাছে নিয়ে যেত সে।’
‘পেইন্টিংটা তিনি বিক্রি করার সময় পাবেন বলে মনে হয় না। ওটা সম্ভবত এখনো তাঁর বাড়িতেই আছে।’
‘আল্লাহর দোহাই লাগে বাপ, কে তিনি?’ বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন সৈকতের আম্মা।
এক চামচ কাবাব মুখে দিয়ে সৈকত বলল, ‘কার বাড়িতে তল্লাশি করতে হবে আমি বলে দিচ্ছি। ভদ্রলোকের নাম…’
পেইন্টিংটা কে চুরি করেছেন?
পাঠকের মতামত