
কেউ বলেন ফানুস বাতি, দেখতে ডোলের ন্যায় বলে কেউ বলেন ডোলবাজি।
কিন্তু বৌদ্ধ পরিভাষায় এর নাম হল আকাশ প্রদীপ।
রাজ কুমার সিদ্ধার্থ (পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ) জাগতিক সকল দুঃখমুক্তি লাভের
আশায় রাজ্য, রাজত্ব, ভোগ বিলাস ধনকুম্ভ সবকিছু ত্যাগ করে সংসার পরিত্যাগ
করেছিলেন শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে। তিনি সারথি ছন্দককে সাথে নিয়ে অশ্ব
কন্থকের পিঠে চড়ে অনোমা নদীর তীরে পৌঁছলেন। রাজ আবরণ ছন্দককে বুঝিয়ে
দিয়ে তিনি সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করলেন। তিনি ভাবলেন, আমি এখন সন্ন্যাসী, রাজকীয়
বাহারি চুল কিবা প্রয়োজন। তরবারি দিয়ে চুলের গোছা কেটে নিলেন।
তিনি মনে মনে অধিষ্ঠান করলেন যদি বুদ্ধ হওয়ার মত গুণ আমার মধ্যে থেকে থাকে
তাহলে উর্ধ্ব দিকে নিক্ষিপ্ত চুলের গোছা মাটিতে না পড়ে আকাশে স্থিত থাকুক। এই
সংকল্প করে তিনি চুলের গোছা উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেন। একটা চুলও মাটিতে
পড়ল না। বৌদ্ধধর্ম মতে স্বর্গের ইন্দ্ররাজা এই চুলগুলো হীরা, মণি মানিক্য খচিত স্বর্ণ
পাত্রে ধারণ করে তাবতিংস স্বর্গে উক্ত কেশ ধাতু স্থাপন পূর্বক একটি চৈত্য নির্মাণ করেন
এবং এই চৈত্যের নাম রাখা হয় চুলামনি চৈত্য। স্বর্গের দেবতারা এখনও উক্ত চুলামনি
চৈত্যের পূজা করে থাকেন।
কিন্তু মর্ত্যলোকের বুদ্ধভক্ত পূজারীরা স্বর্গে তো আরোহণ করতে পারেন না। তাই তারা
পরম শ্রদ্ধায় কাগুজে ফানুস তেরি করে একটি বিশেষ দিনে ধর্মীয় রীতি নীতি মেনে
চুলামনি চৈত্যকে পূজা করার উদ্দেশ্যে আকাশ প্রদীপ হিসেবে ফানুস বাতি উত্তোলন করে
থাকেন। ধর্মীয় গাথা বা মন্ত্র পাঠ করে উৎসর্গ করে খালি পায়ে বৌদ্ধরা প্রদীপ বা বাতি
হিসেবে ফানুস উড়িয়ে উক্ত চুলামনি চৈত্যকে বন্দনা জানান। বিশেষ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুর
দ্বারা মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে সাধু ধ্বনির সুরে সুরে ফানুস উড়ানো হয়।
আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে বৃষ্টি এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় অনেক সময় ফানুস উড়ানোর
পরিবেশ এবং সুযোগ কোনটিই থাকে না। তাই প্রবারণা পূর্ণিমা বা আশ্বিনী পূর্ণিমা
দিনে ফানুস উড়ানো হয়।
ফানুস কোন বেলুন নয় যে যখন তখন যেনতেন ভাবে মনের আনন্দে উড়ানো যাবে।
বেলুন উড়ানোর ক্ষেত্রে কোন কালাকাল নেই, সময় অসময় নেই। রীতি নীতি বা মন্ত্রের
প্রয়োজন নেই। কিন্তু ফানুসের ক্ষেত্রে পালনীয় অনেক বিধি বিধান আছে। ফানুসের সাথে
জড়িয়ে আছে ধর্মীয় আবহ। প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে শত শত ফানুস উত্তোলন করার
প্রয়োজন আছে কিনা এ বিষয়টিও বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
ফানুস উত্তোলনে আনন্দ যেমন আছে, তেমন ঝুঁকিও আছে।
ফানুসের আগুনে ঘর-বাড়ি কিংবা সম্পদের ক্ষতি হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে
যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটাতে ওতপেতে কেউ নেই এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
আবার কেউ সুযোগ নিতে চায় বলে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকেও ভুলে যেতে পারবো
না। তবে একটি নিয়মের মধ্যে ফিরতে হবে বলে মনে করি।
যেমন বুদ্ধের নয়গুণ স্মরণে ৯টি, ধর্মের ছয়গুণ স্মরণে ৬টি এবং সংঘের নয়গুণ
স্মরণে ৯টি ফানুস উত্তোলন করা যেতে পারে।
ফানুস উত্তোলনের সময় আমাদের পূর্ণ দায়িত্বশীল হতে হবে। যে কেউ যেনতেন ভাবে
যেন ফানুস উত্তোলন না করেন। আর ফানুস যাতে উত্তোলন করা মাত্র পড়ে না যায়
এ ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে। আগুন নিয়ে যেন খেলা না হয়।
মূলত আজকে থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফানুস উত্তোলন শুরু হয়েছে।
রামুতে আগামীকাল ২৮ অক্টোবর উত্তোলন করা হবে।
রামু খিজারী হাইস্কুল মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে ফানুস উত্তোলন করা হলেও
বিভিন্ন গ্রাম থেকে আরো অনেক ফানুস উত্তোলন করা হবে।
যেকোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীর
সর্বাত্নক সহযোগিতা আশা করা যাচ্ছে।
পাঠকের মতামত