ঢাকা অফিস।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৭ কর্মীকে গ্রেফতারপূর্ব ও গ্রেফতার-পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং প্রশাসনের নির্যাতনে পঙ্গু করে দেওয়ার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আজ রোববার (১৭ নভেম্বর) ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান এবং সহকারী সম্পাদক আমানুল্লাহ আল জিহাদীর (আদিব) তত্ত্বাবধানে ট্রাইব্যুনালে ৭ ভিকটিম নিজেই এ অভিযোগ দায়ের করেন।
মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং আওয়ামী যুব ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের যোগসাজশে পৃথক পৃথক ঘটনায় মো. আব্দুল করিম, মো. আলমগীর হোসেন, মো. দেলোয়ার হোসেন মিশু, মো. সাইফুল ইসলাম তারেক, মো. নুরুল আমিন, মো. কামারুজ্জামান এবং মো. জনি ইসলামকে গ্রেফতারের আগে ও পরে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এসব নির্যাতনের ফলে তারা স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণ করেন।অভিযোগ নং—১ঘটনার তারিখ: ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১৫স্থান: বিনোদপুর বাজার, মতিহার থানা ভিকটিম: মো. জনি ইসলাম। যিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শাখার কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন।
২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে পড়ার টেবিলে বসে পড়াশোনা করছিলেন মো. জনি ইসলাম। রাত ১১.০০টার দিকে প্রশাসনের লোকজন, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ১৫/২০ জন তার বাড়িতে এসে তাকে পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাড়াহুড়ো করে তাকে বিনোদপুর বাজারে অবস্থান করা গাড়িতে উঠিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। তাকে সেখান থেকে রাজপাড়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় নিয়ে গিয়ে আনুমানিক রাত ১২.০০টার পর থেকে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার করা হয়। তার হাতের কব্জি এবং পায়ের তালুতে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। এর পর তাকে থানার বাইরে দাঁততলা নামক একটি আমবাগানে নিয়ে গিয়ে বাম পায়ে শটগান ঠেকিয়ে ৩টি গুলি করা হয়, যার ফলে তার পা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। গুলির শব্দ শুনে এলাকাবাসী এগিয়ে এলে তারা তাকে দ্রুত গাড়িতে উঠিয়ে আহত পায়ে আরও আঘাত করে।
এরপর তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাকে ৩ দিন পর্যন্ত কোনো ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের করা হলে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়, এখানে আরও ৫ দিন কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ৫ দিন পর তার পায়ের পরীক্ষা করা হয় এবং তার পা থেকে দুর্গন্ধ বের হলে ডাক্তারের পরামর্শে পা কেটে ফেলা হয়। পরে তাকে বন্দুকযুদ্ধের নামে নাটক সাজিয়ে মামলা দেওয়া হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি ২৫টি মামলা নিয়ে জীবনযাপন করছেন।অভিযোগ নং—২
ঘটনার তারিখ: ৩ মার্চ ২০১৩, দুপুর ৩.৩০ মিনিট
স্থান: শেখেরখীল রাস্তার মাথা, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
ভিকটিম: মো. আব্দুল করিম। যিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের বাঁশখালী থানার কর্মী ছিলেন।
২০১৩ সালের ৩ মার্চ, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে এবং মুক্তির দাবিতে শেখেরখীল রাস্তার মাথা থেকে বিকাল ৩.৩০ মিনিটে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আকস্মিকভাবে হামলা চালিয়ে গুলি বর্ষণ করে। একপর্যায়ে একটি বুলেট তার মেরুদণ্ডে আঘাত করে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার তাকে দ্রুত চট্টগ্রাম সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বাধার কারণে স্থলপথে যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়লে সংগঠনের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বিপদসংকুল জলপথে ট্রলারযোগে তাকে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তার মেরুদণ্ড অকার্যকর ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তিনি বর্তমানে ১১ বছর ধরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং সেটাই তার স্থায়ী নিবাস।অভিযোগ নং—৩ঘটনার তারিখ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩স্থান: মির্জাপুর বাজার, শেরপুর, বগুড়াভিকটিম: মো. আলমগীর হোসেন। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের জনশক্তি ছিলেন।২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদির রায়ের প্রতিবাদে পবিত্র শুক্রবার সকাল ৮:০০টার দিকে মির্জাপুর বাজার থেকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়। ইতোমধ্যে পুলিশ, বিজিবি এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা উপর্যুপুরি হামলা ও গুলি চালাতে থাকে। একটি বুলেট এসে তার ডান কানে লাগে। সে আহত অবস্থায় পড়ে গেলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে গাড়িতে ওঠানোর সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এসে পুলিশের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের হাতে থাকা হকিস্টিক, লাঠি এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আঘাত করতে থাকে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ সময় পুলিশ ও বিজিবি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। একপর্যায়ে তাদের হাতে থাকা রামদা দিয়ে দুপায়ে কোপ দেয় এবং মাথায় হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করলে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারা তাকে মৃত ভেবে ৩০ ফুট উঁচু ব্রিজ থেকে ফেলে দিলে তার মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে, সে তখন একটি স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়, এরপর পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে একটি বেসরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ ১১ বছর যাবৎ চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখন হুইলচেয়ারই তার নিত্যদিনের সঙ্গী।অভিযোগ নং—৪ঘটনার তারিখ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২স্থান: মাইজদী পৌর বাজার, নোয়াখালী ভিকটিম: মো. দেলোয়ার হোসেন মিশু।
২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল হয়। তারই ধারাবাহিকতায় নোয়াখালী শহরের মাইজদী পৌর বাজার থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল শুরু হলে পুলিশ হামলা চালায় এবং গুলি বর্ষণ করে। একটি রাবার বুলেট তার ডান চোখে আঘাত করে। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ কেস দেখে কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে একজন ডাক্তারের সুপারিশে চিকিৎসা দিতে রাজি হয় একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসা নিলেও সে তার এই চোখে আর দেখতে পায় না। চিরদিনের জন্য তার এই চোখের আলো নিভে যায়।অভিযোগ নং—৫ঘটনার তারিখ: ১৪ জুন ২০১৭, আনুমানিক বিকেল ৩:০০টা।স্থান: নিজ বাড়ী (সেলিম মাস্টারের বাড়ী, নাপিত পুকুরিয়া, উত্তর পাদুয়া, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম)।ভিকটিম: মো. সাইফুল ইসলাম তারেক। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের স্থানীয় থানার কর্মী ছিলেন।১৪ জুন ২০১৭, বিকেল আনুমানিক ২:৩০ মিনিটের দিকে সাদা পোশাকে কয়েকজন ব্যক্তি তার বাড়ির আঙিনা থেকে এলাকাবাসী এবং তার পরিবারের সদস্যদের সামনে তাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। পরে গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে ফেলা হয় এবং তাকে পতেঙ্গা র্যাব-৭ এ নিয়ে যাওয়া হয়।
দুই দিন পর তাকে বান্দরবন ক্যাসিংঘাটায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে গুমে থাকা জয়নাল আবেদীনকে নিয়ে এসে পতেঙ্গা র্যাব-৭ এ রাখা হয়। সেখানে তাকে ৫৯ দিন একটি কবরের মতো রুমে বন্দি রাখা হয়। এর মধ্যে ৩৯ দিন তাকে কোনো গোসলের সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ৫৯ দিন পর তাকে চোখ বেঁধে অন্যত্র কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে এসে তাকে নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
২০১৯ সালে হঠাৎ সেখানে জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং তিনি জানান যে, তিনি পরবর্তীতে র্যাবের উত্তরা ক্যাম্পে ছিলেন। এরপর, তাকে সেখানে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সাইফুল ইসলাম তারেককে ২০২০ সালের ১৯ জুন ময়মনসিংহ র্যাব-১৫ এ নিয়ে যাওয়া হয়। ২০ জুন ২০২০ সালে তাকে ফুলবাড়িয়া থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠানো হয়। দীর্ঘ ১০ মাস কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।অভিযোগ নং—৬ঘটনার তারিখ: ২৬ জুন ২০১৩, সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিট।
স্থান: গুলশান আজাদ মসজিদ, গুলশান, ঢাকা।
ভিকটিম: মো. নুরুল আমিন। তিনি তৎকালীন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভাটারা থানা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী ঢাকা থেকে গুম হওয়ার পর তাদের সন্ধানে তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সম্পাদক আব্দুস সালামসহ গুলশান থানায় ২৬ জুন ২০১৩ তারিখে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর গুলশান আজাদ মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে বের হলে সাদা পোশাকে র্যাবের একটি টিম প্রথমে আব্দুস সালাম এবং পরে নুরুল আমিনকে ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নেয় এবং তাদের চোখ বেঁধে ফেলে।
প্রায় এক ঘণ্টা পথ চলার পর তাদের কোলে করে নিয়ে চারতলা একটি কক্ষে রেখে দেওয়া হয়। সেখানে তাদের নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
৩ মাস ১৫ দিন পর হঠাৎ একদিন রাত ৩:০০টার দিকে গাড়িতে করে চোখবাঁধা অবস্থায় নুরুল আমিনকে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ঘিওর নামক স্থানে এবং আব্দুস সালামকে সাভারে ফেলে রেখে চলে যায়।অভিযোগ নং—৭ঘটনার তারিখ: ৫ মে ২০১৭, আনুমানিক রাত ২:০০টা।স্থান: ঝিনাইদহ শহর।ভিকটিম: মো. কামারুজ্জামান। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন রতনহাট উপজেলার একটি ইউনিয়ন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ৪ মে ২০১৭ তারিখে তিনি তার বন্ধুর বাসায় যান এবং সেখানেই রাত্রিযাপন করেন।
হঠাৎ রাত ২:০০টার দিকে সাদা পোশাকে ৮-১০ জন লোকের একটি দল এসে জোরপূর্বকভাবে কামারুজ্জামানকে তুলে নিয়ে যায়। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের প্রশাসনের লোক বলে পরিচয় দেয়। তাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার কারণ জানতে চাইলে তারা গালাগাল শুরু করে। এরপর তারা তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
অদ্যাবধি তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি!
পাঠকের মতামত