প্রতিবেদক, রামু
কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারনা পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে কল্প জাহাজ ভাসা উৎসব। উৎসবকে ঘিরে হাজারো নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠে বাঁকখালী নদীর দুই তীর। জাহাজ ভাসানোর আনন্দে মেতে উঠেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়। অপূর্ব কারুকাজে তৈরি একেকটি দৃষ্টিনন্দন জাহাজ নৌকায় বসিয়ে ভাসানো হচ্ছে নদীতে। জাহাজগুলো যাচ্ছে নদীর এপার থেকে ওপারে। সেই জাহাজে চলছে শতশত প্রাণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। শুধু তাই নয়, নদীর দুইপাড়েও নেচে গেয়ে আনন্দে মেতে উঠে হাজারো নর-নারী।
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) কক্সবাজারের রামুর বাঁকখালী নদীর পূর্ব রাজারকুল ঘাটে আয়োজন করা হয় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কল্প জাহাজ ভাসানো উৎসব। দুপুরে শুরু হওয়া এ উৎসব বিকেল গড়াতেই বর্ণিল হয়ে ওঠে হাজারো দর্শনার্থীর অংশগ্রহণে। এবার ভাসানো হয় পাঁচটি কল্প জাহাজ। কক্সবাজার শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রামু উপজেলা সদর পার হয়েই বাঁকখালী নদীর ঘাট।
বিকেল ৩টায় এ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, লোকে লোকারণ্য নদীর দুই পাড়। গান-বাজনা, কীর্তন ও ফানুস ওড়াউড়িতে মেতে উঠেছে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। পাঁচ থেকে ছয়টি কাঠের নৌকার ওপর বসানো হয়েছে একেকটি কল্প জাহাজ। আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায়ও দেখা গেল দুটি জাহাজ। পানিতে ভাসছে মোট পাঁচটি কল্প জাহাজ। মূলত বাঁশ, কাঠ, বেত ও রঙিন কাগজে রঙের কারুকাজে জাদি, হাঁস, ময়ূর, হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবয়বে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এসব কল্প জাহাজ। চমৎকার নির্মাণশৈলী আর বৈচিত্র্যে ভরা প্রতিটি জাহাজই যেন নিজস্ব স্বকীয়তার ভরপুর।
এসব ভাসমান জাহাজে বৌদ্ধ কীর্তন চলছে। কেউ নাচছে, কেউ গাইছে আবার কেউ ঢোল, কাঁসাসহ নানা বাদ্য বাজাচ্ছেন। শিশু-কিশোরদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখে মনে হবে এখনই যেন বাঁধ ভাঙবে!
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, প্রায় দুইশ বছর আগে থেকে এ জাহাজ ভাসা উৎসবের প্রচলন হয় পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। সে দেশের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম এ উৎসবের আয়োজন করেন। শতবছর ধরে রামুতে মহাসমারোহে এ উৎসব হয়ে আসছে।
তিনি বলেন, মহামতি বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে বৈশালী যাওয়ার সময় নাগ লোকের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন নাগেরা চিন্তা করলেন বুদ্ধপূজার এই দুর্লভ সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। সঙ্গে সঙ্গে নাগলোকের পাঁচশত নাগরাজ পাঁচশত ঋদ্ধিময় ফণা বুদ্ধ প্রমুখ পাঁচশত ভিক্ষুসংঘের মাথার ওপর বিস্তার করল।
এভাবে নাগদের পূজা করতে দেখে দেবলোকের দেবতারা, ব্রহ্মলোকের ব্রহ্মরা বুদ্ধকে পূজা করতে এসেছিলেন। সেদিন মানুষ, দেবতা, ব্রহ্মা, নাগ সবাই শ্বেতছত্র ধারণ করে ধর্মীয় ধবজা উড্ডয়ন করে বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। বুদ্ধ সেই পূজা গ্রহণ করে পুনরায় রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। সেই শুভ সন্ধিক্ষণ হচ্ছে শুভ প্রবারণা দিবস।
মূলত চিরভাস্বর এই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধরা বিশেষ করে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রবারণা পূর্ণিমায় বাঁকখালী নদীতে স্বর্গের জাহাজ ভাসিয়ে প্রবারণা উদযাপন করে।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. সুকোমল বড়ুয়া। উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিথুন বড়ুয়া বোথামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুৎফুর রহমান কাজল।
পাঠকের মতামত