গণহত্যা স্মরণ দিবস পালিত
শহিদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন, উখিয়া—
ইংরেজি অক্ষরে ব্যানারে ব্যানারে ‘হোপ ইজ হোম’ লিখে শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গারা বার্তা দিলেন, স্বদেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াই তাদের একমাত্র আশা।
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের দমন-পীড়নের সাত বছর পূর্ণ হয়েছে। ‘কালো দিন’ আখ্যা দিয়ে ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৫ আগস্টে ‘গণহত্যা স্মরণ দিবস’ পালন করে আসছে রোহিঙ্গারা।
এ উপলক্ষে রোববার সকালে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে সমাবেশ পালন করেছে সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। পৃথকভাবে উখিয়ার ৪, ৯, ১৩, ১৮ ও টেকনাফের ২৬ ও ২৭ নম্বরসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে শান্তিপূর্ণভাবে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে বড় সমাবেশটি হয় উখিয়ার লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবিরে।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা নানান প্রতিবাদী বাক্য লেখা ব্যানার, পোস্টার, প্ল্যাকার্ড ও মিয়ানমারের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে সমাবেশে অংশ নেয়।
সমাবেশে বক্তৃতা করেন নেতৃত্বস্থানীয় রোহিঙ্গারা। এ সময় আরাকানে গণহত্যা বন্ধের দাবি ও দ্রত প্রত্যাবাসন-কার্যক্রম চালুর দাবি জানান তারা। এদিন উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরের মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোতে বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।
উখিয়ার লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবিরে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেন রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি মোহাম্মদ মুসা, সৈয়দ উল্লাহ, মোহাম্মদ কামাল, আবদুর রকিম, নারীনেত্রী রশিদা; টেকনাফের শিবিরে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তৃতা করেন ২৬ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি বজলুল ইসলাম, মো. নুর, মাস্টার রফিক, মাস্টার ফাইসেল, মো. আয়াছ মাঝি প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, এমন ভাসমান জীবন আর চান না তারা। জীবনের বাকি সময়টা নিজেদের দেশে কাটাতে চান তারা। আরাকানের জন্য মন কাঁদছে তাদের।
বক্তারা বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। আমরা এই দিবসটি পালন করছি, কারণ এই দিনে মিয়ানমারের জান্তা সরকার আমাদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে; নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছে; আমাদের সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে।’
তারা বলেন, ‘অবিলম্বে আমাদেরকে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে। এই দেশে আর কত বছর থাকব। আর থাকতে চাই না। আমরা আমাদের স্বদেশে ফিরে যেতে চাই।’
এ সময় তারা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। প্রত্যাবাসন সফল করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আন্তরিকভাবে বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তারা। সমাবেশে বক্তারা তাদের নায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। পাশাপাশি অধিকার আদায়ে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
সমাবেশ শেষে মোনাজাতের একপর্যায়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য দোয়া করা হয়। রোহিঙ্গাদের ‘দ্রুত প্রত্যাবাসন’ আশা এ সরকারের প্রতি। ড. ইউনূসের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দাবিদাওয়াগুলো আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে চায় রোহিঙ্গারা।
সমাবেশ থেকে মিয়ানমারে গণহত্যার বিচার, দ্রুত প্রত্যাবাসন, পার্লামেন্টে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, সম্পত্তি ফেরত, প্রত্যাবাসনের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে উত্থাপন না করা; প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দাতাসংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করাসহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়।
সমাবেশের বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক আমির জাফর ও ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যালিয়ানের অধিনায়ক মো. ইকবাল বলেন, রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করেছে। এতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। শিবিরের অভ্যন্তরে কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে এখনো অস্থির রাখাইন। তবুও ফেরার আকুতি জানাচ্ছে রোহিঙ্গারা। দেশটিতে মিয়ানমার সরকার ও আরকান আর্মির চলমান যুদ্ধে মারা যাচ্ছে শত শত রোহিঙ্গা। এমতবস্থায় প্রাণভয়ে মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে নতুনভাবে ঢুকে পড়ছে তারা। এরপর বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। অন্তত নতুন করে ৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে দিন দিন রোহিঙ্গাদের বোঝা আরও বাড়ছে বাংলাদেশের ঘাড়ে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বনভূমিতে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে তিন লাখসহ ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারের ৩৩টি আশ্রয়-শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। কবে তারা স্বদেশে ফিরবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
পাঠকের মতামত