আলাউদ্দিন, উখিয়া—
দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে পতন হয়েছে দম্ভের; কবরস্থ হয়েছে স্বৈরাচারিতা; বিজয় হয়েছে ছাত্র-জনতার।
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পলায়নের ঘটনায় খুশিতে আত্মহারা দেশের জনগণ। স্বৈরাচারের পতনে আনন্দ ও বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছে গোটা দেশ।
তারই অংশ হিসেবে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনতাকে অতি আনন্দের সঙ্গে বিজয়োৎসব পালন করতে দেখা গেছে। পদত্যাগের খবরে আদায় করা হয় ‘সেজদাতুস শোকর’।
৫ আগস্ট থেকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের আনন্দ-উদযাপন শুরু হয় এবং ৬ ও ৭ আগস্ট (গতকাল) পর্যন্ত উখিয়া উপজেলায় নানান ঘটনা ঘটে যায়।
মানুষ দলে দলে যোগ হয়ে পাড়া-মহল্লা, স্টেশন ও প্রধান সড়কে বিজয়-মিছিল বের করেন। উল্লাস চলাকালে বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন উত্তেজিত জনতা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ কদিনে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৩০টি দোকান ভাঙচুর, লুটপাট ও তালাবদ্ধ করা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছে অন্তত ১০টি বাড়িতে। পোড়ানো হয়েছে গাড়িও। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও সাংগঠনিক কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। উখিয়া সদর এলাকায় অনেকটা পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও দখলের খবর পাওয়া গেছে। তবে হামলা হয়নি কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে।
বিজয়োৎসবে উখিয়ার রাজনৈতিক দলগুলো :
ছাত্র-জনতার অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের পতন-উদযাপনে রাজপথে নেমে উল্লাসে মেতে ওঠেন উপজেলার বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল-যুবদল, শিবিরসহ আওয়ামী লীগ-বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক নিয়ে জায়গায় জায়গায় বিজয়-মিছিল করে রাজনৈতিক দলগুলো। উল্লাসে ফেটে পড়ে উখিয়ার জনপদ।
পরিচ্ছন্নতা-অভিযান ও ট্রাফিকপুলিশের ভূমিকায় উখিয়ার শিক্ষার্থীরা :
অনেকটা যুদ্ধবিদ্ধস্ত রাষ্ট্রের মতো হয়ে পড়েছিল এই দেশ। কিন্তু সারা দেশে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেশ-সংস্কারে নেমে পড়েছেন; চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভিযান। দেখা গেছে, গতকাল বুধবার সকালের দিকে উপজেলার ব্যস্ততম স্টেশন কোর্টবাজার, কুতুপালং ও থাইংখালী স্টেশনে ময়লা-আবর্জনা দূর করতে প্রধান সড়কে নেমে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এ সময় যানজট নিরসন ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কর্মবিরতিতে থাকা ট্রাফিকপুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তারা।
উখিয়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে পাহারা :
চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে হামলার আশঙ্কা সৃষ্টি হয় ভিন্ন ধর্মালম্বীদের উপাসনালয়ে। এর প্রেক্ষিতে উপজেলার বিভিন্ন মন্দিরে, বিহারে রাত জেগে পাহারা দিতে দেখা গেছে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনদের। কড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় হামলা হয়নি কোনো মন্দিরে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ উখিয়া শাখার সভাপতি মেধু বড়ুয়া।
রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ ও ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবনতি :
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালনে না থাকায় রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ শুরু হয়েছে। চেকপোস্টগুলো খালি পাওয়ায় সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়। এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেখানে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা। অপরদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
উখিয়ায় কারামুক্ত দুজন :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ভাঙচুর, হত্যা ও বিস্ফোরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া দুজনের কারামুক্তির খবর জানা গেছে। ৬ আগস্ট মুক্তি পান উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাস্টার শওকত আলী কুতুবীর ছেলে জসিম উদ্দিন এবং গতকাল বুধবার মুক্তি পান একই ওয়ার্ডের আব্দুল গফুরের ছেলে মো. জিয়া উদ্দিন আরমান।
উখিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি :
সরকারি, বেসরকারি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কার্যালয় খুলতে শুরু করেছে। কমবেশি চলাচল শুরু করেছে গণপরিবহন ও যানবাহনগুলো। পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
সুনসান উপজেলা আ.লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ :
নিজেদের সরকারের এমন বিদায়ে স্তব্ধ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। ‘কোথাও কেউ নেই’-পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাদের মন ও মননে।
উখিয়ার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে উখিয়া থানার অফিসিয়াল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
উখিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তানভীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে উপজেলার সরকারি নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে, নিরাপত্তা জোরদারে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এদিকে সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। সীমান্ত দিয়ে পলায়নরোধে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে বলা হয়েছে বিজিবির পক্ষ থেকে।
পাঠকের মতামত