প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
চোরাই গরুতে সয়লাব কক্সবাজার-বান্দরবান
# বাড়ছে সংঘাত গোলাগুলি লুটপাট
# প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ গ্রামবাসীর
সোয়েব সাঈদ, রামু::
চোরাই পথে আসা মায়ানমারের গরুতে সয়লাব হয়ে গেছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের রামু উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ। গরু নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, বিজিবির সাথে চোরাকারবারিদের সংঘর্ষে প্রাণহানি সহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে এ দুটি উপজেলায় বিরাজ করতে চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠা।
নাইক্ষ্যংছড়িতে মায়ানমার সীমান্তের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে নির্বিঘেœ এদেশে পাচার হচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে গরু। কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, কখনো আইন শৃঙ্খলা বাহিনী-জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে এবং এলাকার বখাটে-সন্ত্রাসী লোকজনকে দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে পানের পানির মতো পাচার করা হচ্ছে মায়ানমারের গরু। এসব কারণে গরু পাচারের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে দেশজুড়ে।
গরু পাচার করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সীনান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে চোরাকারকারিদের মধ্যে সংঘর্ষ, গোলাগুলি সহ অপ্রীতিকর ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে। পাচারকালে গরু জব্দ করার জেরে বিজিবির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন পাচারকারিরা। এতে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। আবার জব্দ করা গরু ফেরত নিতে বিজিবি ক্যাম্পে হামলাও চালিয়েছে চোরাকারবারিরা। অস্ত্রধারি সন্ত্রাসী চক্র বিভিন্ন স্থানে গরু লুটের ঘটনাও সংগঠিত করছে। গরু নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছেন বিজিবির অনেক সদস্যও।
গত ৮ এপ্রিল রাতে রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের পূর্ব কাউয়ারখোপ এলাকায় মায়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা গরুর চালান জব্দ করে বিজিবি সদস্যরা। এসময় পাচারকারিরা জব্দ করা গরুগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে তারা বিজিবির সদস্যদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। তখন আত্মরক্ষার্থে বিজিবির সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান আব্দুর জব্বার (৪০) নামের এক দোকান কর্মচারি। এ ঘটনায় বিজিবির ৪ সদস্য, মহিলাসহ স্থানীয় একাধিক গ্রামবাসী আহত হন।
এ ঘটনায় নিহত আবদুল জব্বার রামুর কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব কাউয়ারখোপ এলাকার মৃত জাকের আহমদের ছেলে। তিনি স্থানীয় একটি নির্মাণ সামগ্রীর দোকান কর্মচারি হিসেবে কাজ করতেন। স্থানীয়দের দাবি, ঘটনার সময় সংঘর্ষের মাঝে পড়ে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান।
পরদিন ৯ এপ্রিল বিজিবির সদর দপ্তর থেকে জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) মো. শরীফুল ইসলামের পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয় “শনিবার রাতে সীমান্তের চোরাই গরু জব্দ করে টহল দল পায়ে হেঁটে ফেরার সময় কাউয়ারখোপ এলাকায় সংঘবদ্ধ চোরাকারবারী, দুষ্কৃতিকারী ও স্থানীয় সহযোগী প্রায় ২০০ হতে ৩০০ জন লোক দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোটা ও ইটপাটকেলসহ বিজিবি টহল দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে চোরাকারবারি গুলিবিদ্ধ এবং বিজিবির ৪ সদস্য গুরুতর আহত হন। ঘটনার সময় টহলদল সরকারী জানমাল রক্ষার্থে এবং আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে বাধ্য হলে একজন চোরাকারবারি গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ১টি দেশীয় একনলা বন্দুক, ১টি কিরিচ ও ১টি দা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।”
জানা গেছে- এ ঘটনায় ৯ এপ্রিল রাতে জব্দ হওয়া গরু রামু থানায় হস্তান্তর করে। এসময় চোরাচালান, সংঘর্ষ ও অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় জড়িত ২৫০ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করে বিজিবি। তবে এসব ঘটনায় এখনো কাউকে আটক করা হয়নি বলে জানা গেছে।
এরআগে গত ১ এপ্রিল জব্দ করা গরু ফেরত নিতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি বিজিবি ক্যাম্পে হামলা চালায় চোরাকারবারিরা। ওই হামলায় আহত হন বিজিবির সদস্য হাবিলদার চম্বক কুমার পাল, নায়েক মুশফিকুর রহমান ও নায়েক মো. হাছান। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন সুমন তংচংঙ্গা (২৮), চুতিঅং তংচংঙ্গা (৩৬) রৈশমং তংচংঙ্গা (৬০) ও আনতুমং তংচঙ্গা (৪০)।
এছাড়া গত ২৯ মার্চ রামু উপজেলার কচ্ছপিয়ায় গুলি ছোড়ে আতংক সৃষ্টি করে এবং দুইজন গরু ব্যবসায়িকে দা দিয়ে কুপিয়ে মায়ানমারের ৯টি গরু ছিনতাই করে স্থানীয় কিছু বখাটে। একাধিক সূত্রমতে, ওইদিন রাতে চোরাকারবারী জসিম, আবুল কালাম ও কালু গং নাইক্ষ্যছড়ি সীমান্তের ৪৬-৪৭ পিলার থেকে বার্মিজ ২৪ টি গরু নিয়ে আসে কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বালুবাসা গ্রামে । সেখান থেকে এসব গরু শুকমুনিয়া-দৌছড়ি ও কচ্ছপিয়া গ্রামের টেকপাড়া হয়ে মাঝির কাটা পার করছিলো পাচারকারিরা। পথিমধ্যে জনৈক রাসেল বাহিনীর ১৩/১৪ জন সদস্য এসে গরুগুলো লুট করতে বিস্ফোরকদ্রব্য ফোটায়। এতে এলাকাবাসী ও নামাজরত মুসল্লীরা ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ ঘটনায় বখাটেরা ৯ টি গরু লুট করে পালিয়ে যায়। পরে দা এর কোপে আহত মাহবুবুর রহমান নামের এক যুবককে এলাকাবাসী মূমূর্ষ অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। এখনো তার অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- রামু উপজেলার গর্জনিয়া বাজারটি সাম্প্রতিক সময়ে চোরাই গরুর ডিপোতে পরিনত হয়েছে। এ বাজারে সপ্তাহে দুইদিন গরু বিক্রির হাট বসে। স্থানীয়দের অভিযোগ পুলিশ ও ইজারাদারের যোগসাজশে এ বাজারে মায়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা গরুর রমরমা বেচাকেনা হচ্ছে। বাজারে প্রতিটি চোরাই গরু বিক্রির জন্য পুলিশ প্রশাসনও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে। ইজারাদার সহ প্রশাসনের অনেক দপ্তরেও এসব অর্থের ভাগ দিতে হয় বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
মায়ানমারের চোরাই গরুর কারণে বাজারে দেশী গরুর চাহিদাও এখন আগের মতো নেই। ফলে রামু, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার খামারী ও প্রান্তিক কৃষকরা এখন নিঃস্ব হতে চলেছে। যার প্রভাব পড়েছে পুরো কক্সবাজার সহ আশপাশের জেলাগুলোতেও। ক্ষতিগ্রস্ত গরুর খামারীরা জানান- রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, রাজারকুল, ফতেখাঁরকুল, জোয়ারিয়ানালা, রশিদনগর, ঈদগড়, খুনিয়াপালং ইউনিয়নের প্রত্যন্ত জনপদ ও পাহাড়ী এলাকা হয়ে এসব গরু দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে। এছাড়াও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের চাকঢালা, আশারতলী, ফুলতলী, লম্বাশিয়া, সোনাইছড়ি ও দোছড়ির পয়েন্টের চোরাইপথ দিয়ে দিনরাত পাচার হচ্ছে মায়ানমারের গরু। গর্জনিয়া বাজারের মতো চোরাই গরুর অধিকাংশ বিক্রির জন্য নেয়া হয় কক্সবাজার সদর উপজেলার খরুলিয়া গরুর হাটে। এখানেও বাজারের ইজারদারদের জোগশাজসে বিক্রির রশিদ নিয়ে কৌশলে দেশের বিভিন্নস্থানে পাচার করা হয়।
মায়ানমার থেকে আসা চোরাই গরু মজুত করতে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অসংখ্য বাড়িতে এখন গড়ে তোলা হয়েছে অস্থায়ী খামার। মূলত খামারী সেজে এসব বাড়িতে মায়ানমারের চোরাই গরু মজুত করেন। সেখান থেকে গর্জনিয়া বাজারে বিক্রির জন্য নেয়া হয়। এছাড়া দূরদূরান্তের অনেক ক্রেতাও দালালদের মাধ্যমে এসব বাড়ি থেকে গরু কিনে নিয়ে যান। এসব বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশের কথিত সোর্স গরু প্রতি মাসোহারা নিচ্ছে। পুলিশকে টাকা না দিলেই এসব গরু জব্দ করে নিলাম দেয়া হয়।
রামু উপজেলা ডেইরী এসোসিয়শনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ জানান- সীমান্ত অরক্ষিত থাকার কারণেই মূলত প্রতিদিন শত শত গরু মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি-রামু হয়ে এদেশে পাচার হচ্ছে। সীমান্ত এভাবে অরক্ষিত হলে যে কোন অঘটনও সংগঠিত হতে পারে। মায়ানমারের সীমান্ত রক্ষীরা এদেশে এসে লুটপাট করতে কতক্ষণ। যা উদ্বেগজনক। তিনি বলেন- সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমারের গরু বানের পানির মতো এদেশে আসছে। এরফলে দেশীয় খামারী ও প্রান্তিক গরু মালিকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আগামী কোরবানীর ঈদে গরু বিক্রি করে স্বাভলম্বী হওয়ার স্বপ্ন এখন দূঃস্বপ্নে পরিনত হয়েছে। অনেকে এখন পূঁজি হারানোর পথে। এভাবে চলতে থাকলে দেশে গরু লালন-পালন সবাই ছেড়ে দেবে। মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ গরু আটককালে গুলিতে যুবকের মৃত্যু এবং বিজিবি সদস্যদের উপর বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন- এসব ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিজিবি সেক্টর কমান্ডার (রামু) কর্ণেল মোঃ মেহেদী হোছাইন কবির বলেন- সীমান্তে অন্যান্য চোরাচালানের পাশাপাশি গবাদি পশু চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন স্তরের লোকজন এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এ কাজে যারা জড়িত তাদের পাশাপাশি গড় ফাদারদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। সময়ের দূর্যোগ নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত চোরাকারবারীরা। যা রাষ্ট্রের আর্থিক অবকাঠামো ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্র বিশেষ। আজ খামারগুলো বন্ধ হতে চলেছে। এ কারবার দেশের সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। গত কয়েক মাসে সীমান্তরক্ষীরা দেড় হাজার গবাদী পশু জব্দ করে সীমান্তের এ পয়ন্টে। যা পাচারের ১০ ভাগ মাত্র। বাকী গুলো পাচার হয়ে গেছে। অথচ সরকার চাচ্ছে প্রাণী সম্পদ বাড়াতে। চোরাচালান বন্ধে তিনি জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী, সরকারী- বেসরকারী সকলের সহায়তা কামনা করেন। গত ১৫ মার্চ নাইক্ষ্যংছড়িতে ১৫ বিজিবি আয়োজিত চোরাচালান বন্ধে সচেতনতামূলক সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ওই সভায় নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল মোঃ রেজাউল করিম বলেন- সীমান্তে গরু চোরাচালান বন্ধে বিজিবি সজাগ রয়েছে। এজন্য বিজিবি সদস্যরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে।
রামু থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনোয়ারুল হোসাইন জানান- মায়ানমার থেকে সাম্প্রতিক সময়ে চোরাই পথে গরু আসছে। পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালিয়ে গরু আটক করছে। গরু পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পাঠকের মতামত