মাথা গোঁজানোর জন্য নতুন করে কাজ শুরু করেছে রোহিঙ্গারা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫ বছরে নাশকতাসহ ৩ শতাধিক বার অগ্নিকান্ড, ক্লু লেস-৬৩
# ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন।
পলাশ বড়ুয়া, উখিয়া::
ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ঘর পুড়ে যাওয়ার পর পর নতুন করে আশ্রয়স্থল গুছাতে শুরু করেছে ক্ষতিগ্রস্থ ২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পরিবার। এ নিয়ে গত পাঁচ বছরে দুর্ঘটনা ও নাশকতাসহ ৩ শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় স্থানীয়দের বাড়িঘরও পুড়েছে। বেশিরভাগ পুড়েছে রোহিঙ্গাদের ঘর। পুড়েছে মসজিদ, মক্তবসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিষ্ঠান। অনেক সময় বড় ধরনের প্রাণহানিও হয়েছে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক এবং ৬৩টির কারণ জানা যায়নি।
প্রায়ই সময় কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকান্ডে হাজার হাজার ঘর পুড়েছে, নিঃস্ব হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। ঘুরে ফিরে কেন ক্যাম্পেগুলোতে আগুন লাগছে, এর কারণ কী এমন নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ রবিবার (৫ মার্চ) বিকালে উখিয়া বালুখালীতে তিনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা ঘটে। আগুনে দুই হাজার ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। বিকাল ৩টার দিকে প্রথমে ১১ নম্বর ক্যাম্পের বি ও ই ব্লকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে পার্শ্ববর্তী ১০ ও ৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
আজ সরেজমিনে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া ঘরের তলায় নতুন করে মাথা গোঁজানোর জন্য কাজ শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। তাদের পাশে দাঁড়াতে দাতা সংস্থার লোকজনও মাঠে কাজ করছে।
এদিকে রোহিঙ্গা নেতারা বলছে, ক্যাম্পে বারবার আগুনের পেছনে মিয়ানমারের বিচ্ছিনতাবাদী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নাশকতার অংশ হিসেবে অগ্নিকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা নেতা রফিক বলেন, ‘ক্যাম্পের বারবার আগুন লাগার পেছনে অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে। কিছু দিন যেতে না যেতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কেন ঘটে? আগের ঘটনা গুলো তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এতদিন ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠি আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সম্প্রতি ক্যাম্পে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো সশস্ত্র সংগঠন আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যরা। ফলে ক্যাম্পে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এর জেরে একপক্ষ আরেকপক্ষকে উচ্ছেদ এবং ফাঁসাতে শিবিরে আগুন দিতে পারে।’
ঢ়
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৮টি, ২০১৯ সালে ১০, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যদিও সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে ২২২টি ছিল। ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া চলতি বছর গত তিন মাসে ছোট-বড় ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
রবিবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২ হাজার পরিবারের ১২ হাজার মানুষের ঘর আগুনে পুড়ে গেছে। আগুন লাগার পেছনে নাশকতার অভিযোগে সন্দেহজনক স্থানীয় ১৭ বছরের এক কিশোরকে আটক করা হয়েছে।
জানতে চাইলে শরণার্থী ক্যাম্পে দায়িত্বে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, ‘আজ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর দৌঁড়ে পালানোর সময় রোহিঙ্গারা এক কিশোরকে আটক করে। তাকে জিজ্ঞেসাবাদ চলছে।’
ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আগেও ঘটেছে উল্লেখ করে অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, ‘আগুন লাগার কারণ জানতে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে । আর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পেছনে অন্য কারণ আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখছি। পাশাপাশি ক্যাম্পে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রতি বছর শিবিরগুলোতে ৬০-৫০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও মাইকিং আর মহড়া ছাড়া সংশ্লিষ্টদের জোরালো ভূমিকা চোখে পড়ে না। শিবিরে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখেনি।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, ‘আগের তুলনায় ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমেছে। তাছাড়া আগুন লাগার সঠিক কারণ জানাও কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘মূলত রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানে ঝুপড়ি ঘর আছে। তাই আগুন লাগলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। বেশিরভাগ ক্যাম্পে প্রশস্ত রাস্তা না থাকায় ভেতরে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার পানির উৎস কম। তাই আগুন লাগলে শিবিরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়।
এরই মধ্যে গত শুক্রবার (৩ মার্চ) রোহিঙ্গাভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল ‘রোহিঙ্গা রিয়েল ভয়েস’-এ প্রচারিত একটি ভিডিওতে এক আরসা নেতাকে উদ্ধৃত করে এক রোহিঙ্গার অডিও প্রচার করা হয়। অডিওতে অজ্ঞাতপরিচয় ওই রোহিঙ্গা নিজেকে আরসার সদস্য দাবি করেন। যারা আরসাকে ‘দমনে’ জড়িত তাদের হুঁশিয়ারি দেন তিনি। অডিও বার্তায় বলা হয়, ‘ক্যাম্পে বড় ধরনের ঘটনা ঘটানো হবে, যদি আরসার ওপর ক্ষোভ বন্ধ না হয়।’
বার্তাটি প্রচারের দুই দিনের মাথায় এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো।
অডিও বার্তার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে উল্লেখ করে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান ‘খবর পেয়ে দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ড নাশকতা কি না তা জানতে কাজ শুরু করেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্রে করে যাতে ক্যাম্পে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য পুলিশ সর্তক অবস্থানে রয়েছে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না, তা আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। সন্দেহভাজন একজনকে এরইমধ্যে আটক করা হয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ড পরিকল্পিত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
এর আগে ২০২১ সালে ২২ মার্চ একই ক্যাম্পসহ পাশ্ববর্তী তিনটি ক্যাম্পে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় আগুনে ১০ হাজারেরও বেশি বসতঘর পুড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছিল। এছাড়া দগ্ধ হয়ে দুই শিশুসহ ১৫ জন রোহিঙ্গা মারা যায়।
পাঠকের মতামত