টাঙ্গাইলের কালিহাতি গড়িয়ার বাসিন্দা পারুল আক্তার (১৫) ও নাছির উদ্দীন সরকার (১৯) একে অপরকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেন। পারুলের পরিবার প্রেমের বিয়ে মানতে পারেনি। তাই মেয়েকে নিজে হত্যা করে জামাতাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন বাবা আব্দুল কুদ্দুস খাঁ। সাত বছর তদন্ত করেও থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি এই ঘটনার কোনো কুল-কিনারা করতে না পারলেও পিবিআই এই তথ্য জানিয়েছে।
রবিবার (২২’জানুয়ারি) সকালে ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।
আদালতে কুদ্দুসের দেওয়া জবানবন্দি তুলে ধরে তিনি বলেন, মেয়েকে ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে নিজের গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করে ও গলাটিপে হত্যা করেন আব্দুল কুদ্দুস। পরে লাশ নদীতে ফেলে দিয়ে টাঙ্গাইলে চলে যান। মেয়ের কারণে অপমানবোধ ও রাগ থেকে তিনি এই কাজ করেন।
বনজ কুমার বলেন, তদন্তে নেমে একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে এগোতে থাকে পিবিআই। প্রথমে গফরগাঁওয়ে কর্মস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয় পারুলের স্বামী নাছিরকে৷ এরপর ডাকা হয় পারুলের পরিবারের ১৮ সদস্যকে। নাছিরসহ পারুলের পরিবারের সবাই অসংলগ্ন তথ্য দিতে থাকেন। দুই পক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পারুলের বাবা তার বন্ধু মোকা মন্ডলকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ে পারুলকে নিজ হাতে হত্যার কথা স্বীকার করেন পিবিআইয়ের কাছে। এরপর আদালতের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
নিজ হাতে মেয়েকে খুন করার পরেও নানা পর্যায়ে আইনি লড়াই কেন করলেন পারুলের বাবা– এমন প্রশ্নের জবাবে পিবিআই প্রধান বলেন, এটি একটি অনার কিলিংয়ের ঘটনা। মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করায় বাবা কুদ্দুস ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় ও সম্মানহানির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
তাই শাস্তি হিসেবে মেয়েকে খুন করেছেন। কিন্তু এই সন্মানহানির পেছনে তার মেয়ের সঙ্গে জামাতা নাছিরেরও সমান হাত আছে৷ তাই মেয়ের মতো জামাতা নাছিরকেও শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন কুদ্দুস। তিনি (কুদ্দুস) চেয়েছেন এই খুনের মামলায় নাছিরের যেন ফাঁসি হয়। তাহলেই তার সন্মানহানির প্রতিশোধ সম্পূর্ণ হবে। এ জন্যই নিজে মেয়েকে খুন করেও বিভিন্ন পর্যায়ে আইনি লড়াই করেছেন তিনি।
এখন তাহলে পারুলের স্বামী নাছিরের কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশা করি আইনি জটিলতা কাটিয়ে নাসির দ্রুতই মুক্তি পাবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এস.আই বিশ্বজিৎ বিশ্বাস। তিনি বলেন, জবানবন্দিতে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করায় কুদ্দুস ও তার বন্ধু মোকাদ্দেস ওরফে মোকা মন্ডলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের আদালতে তোলা হবে।
ঘটনা প্রবাহঃ
বিয়ের পরে পারুল ও নাসির আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে ভাড়া বাড়িতে সংসার পাতেন। সাংসারিক জীবনে শুরু হয় টানাপোঁড়ন। এক পর্যায়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা পারুল বাবা আব্দুল কুদ্দুস খাঁ’কে মুঠোফোনে বিস্তারিত জানিয়ে সাহায্য চান। কুদ্দুস মেয়েকে সুন্দর ভবিষ্যৎ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসে স্বামী নাছিরকে ছেড়ে যেতে বলেন। সুযোগ বুঝে পারুল ২০১৫ সালে ১৮ জুলাই স্বামীকে না জানিয়ে ফিরে আসেন বাবার কাছে।
পরদিন বাবা কুদ্দুস মেয়েকে নিয়ে যান ভুঞাপুরে তার বন্ধু মোকাদ্দেস ওরফে মোকা মণ্ডলের বাড়িতে। মোকা মণ্ডল আশ্বাস দেয়, ভবিষ্যতে পারুলকে প্রতিষ্ঠিত করবে, এর জন্য কিছুদিন তার স্বামী নাছিরের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে। এই আশ্বাস দিয়ে জয়পুরহাটের উদ্দেশে রওনা দেয় তারা।
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় তুলসীগঙ্গা নদীর পাশে রাতের অন্ধকারে হাঁটথে থাকে তারা তিনজন (পারুল,কুদ্দুস ও মোকা)। একটি নির্জন জায়গায় অন্ধকারে পারুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তার বাবা। এরপর মোকা মন্ডলের সহযোগিতায় পারুলের পরনের ওড়না দুই টুকরা করে হাত-পা বেঁধে ফেলে। তারপর গলা টিপে হত্যা করে।
এরপর জামাতা নাছির ও তার পরিবারকে ফাঁসাতে একটি গুমের মামলা করেন পারুলের বাবা। মামলার তদন্তে কালিহাতি থানা-পুলিশ প্রেমের বিয়ের সংশ্লিষ্টতা পায়। কিন্তু ভুক্তভোগী পারুলকে না পাওয়ায় এবং ঘটনাস্থল কালিহাতী থানার আওতাধীন না হওয়ায় এই মামলা তাদের এখতিয়ারের বাইরে বলে প্রতিবেদন দাখিল করে।
এবার মামলার বাদী পারুলের বাবা কুদ্দুসের বারবার নারাজি দিলে টাঙ্গাইলের ডিবি পুলিশ, পিবিআই ও সিআইডি তদন্তে নামে। তারাও কোনো কুল-কিনারা করতে না পেরে প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। এরপরও ক্ষান্ত হচ্ছিলেন না কুদ্দুস। সবশেষে আদালত জুডিশিয়াল তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়, বাদী ঢাকার আদালতে মামলা করলে প্রতিকার পেতে পারেন।
এবার কুদ্দুস খাঁ আগের তদন্তের রেফারেন্সসহ মামলা করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আদালতে। অভিযোগ করা হয় নাছির উদ্দীন যৌতুকের জন্য তার মেয়ে পারুলকে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন। গত ডিসেম্বরে দায়ের করা এই মামলার তদন্ত ভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পাঠকের মতামত