গাজীপুরের বাসন থানায় পুলিশের নির্যাতনে রবিউল ইসলাম নামে এক সুতা ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। যদিও পুলিশ বলছে, নির্যাতনে নয়, সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হয়েছেন। তবে এই ঘটনার পর বাসন থানার দুই এএসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন ভোগড়া পেয়ারা বাগান এলাকা থেকে সুতা ব্যবসায়ী রবিউলকে অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রতিবেশী স্বপন খানসহ স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, শনিবার (১৪ জানুয়ারি) রবিউলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার সঙ্গে আরও তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের ছেড়ে দিলেও পুলিশ মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত রবিউলকে ছাড়েনি। বাসন থানা পুলিশ মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে রবিউলের স্ত্রী নুপুর বেগমকে খবর দিয়ে থানায় নিয়ে যায়।
থানায় গেলে পুলিশ তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে জানান, তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। ওই রাত ৩টায় তিনি জানতে পারেন তার স্বামী ঢাকা মেডিক্যালে মারা গেছেন।
প্রত্যাহার হওয়া দুই এএসআই হলেন মাহবুবুর রহমান ও নুরুল ইসলাম। মারা যাওয়া রবিউল ইসলাম রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার শাহাদাতপুর (পোস্ট গুজিপাড়া) গ্রামের বাকি মণ্ডলের ছেলে।
এই ঘটনায় রবিউলের মামাতো ভাই আব্দুল কালাম দাবি করেন, ‘আমার স্বামীকে একনজর দেখতে দেন- স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের কাছে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার পর এই কথাটিই বলেছিলেন মারা যাওয়া রবিউল ইসলামের স্ত্রী নুপুর।
কিন্তু পুলিশ তা না করে উল্টো তার কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য পাগল হয়েছিলো। রবিউল এলাকায় সবার কাছে সহজ-সরল মানুষ হিসেবে পরিচিত। তার নামে কোনও মামলা নেই। কারও সঙ্গে উঁচুস্বরে সে কখনও কথা বলেনি। সে সুতা, বোতাম, বক্রম ও পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত নানান উপকরণ বিক্রি করতো।’
রবিউলের প্রতিবেশী ও রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার তারাজুল ইসলাম, আব্দুল ছালাম দাবি করেন, ‘রবিউলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর একাধিকবার তার স্ত্রী পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তার স্ত্রী পেয়ারাবাগে তার স্বজনদের থানার আপডেট খবর জানিয়েছেন। রবিউলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িতে উঠিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়।’
তারা আরও দাবি করেন, ‘রবিউলের স্ত্রী নুপুর আমাদের জানান, তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া দেলোয়ারসহ অপর দুজনের কাছ থেকে ৩০ হাজার করে টাকা নিয়ে আটকের দিনই ছেড়ে দেওয়া হয়। রবিউলের স্ত্রী যতবার থানায় গেছেন ততবারই তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা ঘুস চেয়েছেন। ধরে নিয়ে যাওয়ার দিন ৮৫ হাজার টাকা পুলিশকে দিয়েছেন। রবিউলের মোবাইলে পাঁচ কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়েছে দেখতে পেয়ে পুলিশ তাকে ছাড়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে।’
প্রতিবেশী আয়তাল দাবি করেন, ‘রবিউলকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নুপুরকে বাসন থানা পুলিশের লোকজন বাসা থেকে গাড়িতে করে নিয়ে যান। গাড়িতে বসেই নুপুরের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। এ সময় নুপুর রবিউলকে দেখতে চাইলে রাতে বাসায় ফিরবে বলে স্বাক্ষর দিতে জোরাজুরি করেন। স্বাক্ষর নেওয়া হলে তাকে আর থানায় নেয়নি, মাঝপথে থেকেই বাসায় দিয়ে যায়।’
তিনি আরও দাবি করেন, ‘রবিউল ১০ বছরের জন্য পেয়রাবাগ এলাকায় জায়গা ভাড়া নিয়ে বাড়ি করে সেখানেই থাকেন। তার রুম ভাড়া দেওয়া আছে। কোনও ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি। কখনও জুয়া খেলাতো দূরের কথা ধূমপান পর্যন্ত করতেন না।’
স্থানীয় মুড়ির মোয়া বিক্রেতা ও রবিউলের প্রতিবেশী রংপুরের পীরগঞ্জের দাইড়কাপাড়া এলাকার আব্দুস ছালাম দাবি করেন, ‘রবিউলের সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া দেলোয়ারকে শনিবার রাত আড়াইটার দিকে এএসআই মাহবুবের কাছে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।’
রবিউল গাজীপুরের পেয়পারাবাগ এলাকার শাহানাজের গলিতে থাকতেন। সেখানে ৯০ ভাগ ভাড়াটিয়ার গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায়। তারা ওই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবনযাপন করছেন।’
নিহত রবিউল গত ১৫ বছর ধরে পেয়ারাবাগ এলাকায় সপরিবারে বসবাস করছেন। তার দুই মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে বয়স ১০ ও ছোট মেয়ের বয়স ৮।
রবিউলকে কোর্টে না পাঠানোর বিষয়ে ওই এলাকায় বসবাসরতদের অভিযোগ, ‘ঢাকা-টাঙ্গাইল বাইপাস সড়কে ভ্যানগাড়িতে পণ্য বিক্রিসহ নানা কারণে প্রায়ই পুলিশ বিভিন্ন লোকজনকে ধরে নিয়ে আদালতে পাঠায়। যারা টাকা দিতে পারে তাদের থানা থেকেই ছেড়ে দেয়। কিন্তু রবিউলকে চার দিন পুলিশ কেন থানায় রাখলো? পুলিশ তাকে নির্যাতন করে মেরে বলছে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমরা এখন সব বলে দিচ্ছি। পুলিশ লোক ধরে নিয়ে যায় আর টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছেড়ে দেয়। গত তিন বছর ধরে পুলিশ এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমরা সত্য বলে দেওয়ার জন্য যদি মরতে হয় তবে মরবো। পুলিশ আমাদের এলাকায় কী করছে সব সত্য বলে দেবো।’
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধ বিভাগের উপ-কমিশনার (উত্তর) আবু তোরাব শামসুর রহমান বলেন, ‘টাকা নিয়ে আসামি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা আমি আপনাদের কাছ (সাংবাদিক) কাছ থেকে শুনলাম। তদন্ত করে দেখবো। এমন হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পাঠকের মতামত